গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী | ফিলিস্তিনের মুক্তির দূত

 গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী | ফিলিস্তিনের মুক্তির দূত

গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী

আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর আগে যখন মুসলিমদের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস ছিল খ্রিস্টান শক্তির প্রধানতম তখন একজন সাহসী ও নির্ভীক মুসলিম কমান্ডার বলেছিলেন জেরুজালেম যতদিন ক্রসিডারদের দখলে ততদিন আমি কি করে আনন্দ করতে পারি আমি কি করে তৃপ্তি সহকারে উদরপূর্তি করতে পারি আমি কি করে রাতের বেলায় শান্তিতে ঘুমাতে পারি আজ আমরা ইতিহাসের সেই ক্ষণজন্মা মানুষটির গল্প তুলে ধরতে যাচ্ছি।  যিনি মাত্র ৭ বছর বয়সে নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন ফিলিস্তিনে মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের একজন অকথ্য ভয় বীর সেনানী যার দৃঢ়তা ছাড়িয়ে যায় পর্বতের উচ্চতাকেও তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্টের মহানায়ক যার নেতৃত্বে মুসলিমদের পবিত্র স্থান পাইতুল মুকাদ্দাস প্রায় একশো বছর পর খ্রিস্টানদের দখল মুক্ত হয়েছিল।


তিনি জীবনভর পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন অথচ তার বিরল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে পাশ্চেত্তর ইতিহাসে তাকে স্থান দেয়া হয়েছে একজন সমীহ জাগানো আদর্শ সমনায়ক হিসেবে অবহেলিত করা হয়েছে ডেকোরেট সেনাদির নামে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের ত্রাণকর্তা জেরুজালেম ও ফিলিস্তিন বিজেতা বাগদাদে একজন বিখ্যাত কাঠমিস্ত্রি বাস করতেন তিনি কাঠের ১ জাকজমক মিম্বার গড়ে তুলেছিলেন যার সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করেছিল যখনই কেউ বাগদাত ভ্রমণ করতো তারা সেই কাঠমিস্ত্রির সন্ধান করত কেউ কেউ তাকে অনুরোধ করতো মিম্বারটি আপনি আমাদের কাছে বিক্রি করে দেন যেন আমরা একে কোন মসজিদে স্থাপন করতে পারি।


কিন্তু তিনি সবাইকে একটি কথাই বলতেন আমি এই মিম্বার বাইতুল মুকাদ্দাস এর জন্য নির্মাণ করেছি

এটা এমন এক সময়ের কথা যখন মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত একসময়কার জৌলুশ হারিয়ে তখন নিভু নিভু আব্বাসীয় খেলাফত মিশরে প্রতিষ্ঠিত ফাতিমায় খেলাফত যারা যতটা না ক্রোসেডেন্টদের বিরুদ্ধে স্বচ্ছার ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে অন্যদিকে সকল পরাক্রম হারিয়ে অভ্যন্তরে নানা সংখ্যার ষড়যন্ত্রে পতনের দ্বারপ্রান্তে এককালের পরাক্রমশালি মুসলিম সেলচুক সাম্রাজ্য এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বহু মুসলিম শাসনের উত্থান ঘটেছিল যারা কেউ কারো নেতৃত্ব স্বীকার করত না ফলে মুসলিম উম্মাহ ছিল ঐক্যহীন বিভক্ত এক জনগোষ্ঠীর মতো আর এরই সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিস্টানরা।

গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী


১০৯৫ সালে পোপ আরবানের আহ্বানে প্রায় ১০০০০০০ সৈনিক এক বিশাল ক্রুসেডর বাহিনী প্রস্তুত করে জেরুজালেম অভিমুখে যাত্রা করে খ্রিস্টান শক্তি প্রথি মধ্যে বহু যুদ্ধ জয় পরাজয়ের পর ১০৯৯ সালে সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয় তারা অতঃপর ৭ জুন জেরুজালেমে বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে এবং পনের জুলাই শহরে প্রবেশ করে আর এর মধ্যদিয়ে পবিত্র ভূমি আল কুফসে চারশো ৬২ বছরের মুসলিম শাসনের সমাপ্তি ঘটে সেদিন ক্রুসেডর রা জেরুজালেমের রক্তের বন্যা বয়ে দিয়েছিল কি নারী কি পুরুষ কি শিশু কি বৃদ্ধ যাকে পেয়েছে তাকে হত্যা করেছে আর এভাবেই রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ইউরোপীয়রা প্রতিষ্ঠা করে কিংডম অফ জেরুজালেম।


মুসলিম ও ইহুদীদের উপর চলতে থাকে অকথ্য নির্যাতন ক্রুসেডরদের প্রতি ছিল পোপের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন আর ইউরোপের সকল রাজাদের সম্মিলিত সহযোগিতা অন্যদিকে মুসলিমরা ছিল ঐক্যহীন পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত ফলে প্রায় ১০০ বছরের জন্য খ্রিস্টানদের হাতে জিম্মি হয়ে যায় জেরুজালেম এই ১০০ বছরে একটি দ্বীনের জন্য আযানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি ইসলামের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসে। 


তথাপি প্রতিটি মুসলিমের স্বপ্ন ছিল একদিন তার বাইতুল মুকাদ্দাসের অধিকার ফিরে পাবেন ব্যতিক্রম ছিলেন না বাগদাদের ওই কাঠ মিস্ত্রি তিনি অতিথিদের কে বলতেন নিশ্চয়ই একদিন কোন মহান ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে যিনি জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করবেন সেদিন নিশ্চয়ই আমার এই মিম্বার তার স্থান খুঁজে পাবে তারকার জমায়ে সেই মেম্বারের গল্প ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে দূরের ১ শহরে সাতটি ৮ বছরের ১ বালকের কানেও পৌঁছে যায় বাগদাদের সেই বৃদ্ধ মিস্ত্রি আর তার আবেগ মেশানো মেম্বারের কথা আর তখনকার প্রতিটি বালকের মত সেও জানতো জেরুজালেমে মুসলিমদের উপর বর্বর উচ্চিত হত্যাকান্ডের ঘটনা বালকটি সেদিন আপন মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল।


সে একদিন বৃদ্ধ মানুষটির স্বপ্ন পূরণ করবে অতটুকুন বয়সেই সে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল

আমি একদিন জেরুজালেম জয় করবো আর মেম্বারটিকে সেখানে স্থাপন করবো বালকটির নাম সেলাহাল দ্বীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব ইতিহাস যাকে চিনেছে সালাউদ্দিন আয়ুবিনামে সালাউদ্দিন ইরাকের তীরকে শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার পিতা নাজিম উদ্দিন আয়ু ছিলেন কুর্তি বংশোদ্ভূত একজন শাসক তবে বাল্যকালে সালাউদ্দিন এর সামরিক বিষয়ে হাতেখড়ি হয় চাচা আসাদ উদ্দিন শির্কর হাত ধরে সালাউদ্দিন যখন বেড়ে ওঠেন।


ভাগ্য তার জেরুজালেম জয়ের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল একজন সাধারণ সেনা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ সামরিক ব্যক্তিত্ব ও দক্ষ শাসক আর ইতিহাসে একজন সালাউদ্দিন আয়ুবির এই উদ্যানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন আরেকজন মহান সমর নায়ক নুরুদ্দিন জেমকি নুরুদ্দিন ছিলেন জেমকি বংশের সুলতান যিনি সমস্ত তুর্কি শাসকদেরকে তার অধীনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বিচ্ছিন্ন মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকে তিনি যতটা সম্ভব ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি ক্রসেডারদের হাত থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বহু শহর পুনরুদ্ধার করেছিলেন আর তার হাত ধরেই বিকশিত হয়েছিল সালাহউদ্দিনের সামরিক প্রতিভা


নুরুদ্দিন জঙ্গি শাসনামলে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ক্রসেডাররা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করছিল এগারোশো ৫৮ সালে তারা মিশরের রাজধানী কায়রোতে আক্রমণ করে মিশর তখন শাসন করছিলেন ফাতেমিও খলিফা আল আজিব ক্রসেডারদের মোকাবেলায় তিনি নিজেকে অসহায় অনুভব করেন এবং নুরুদ্দিন জঙ্গির সাহায্য প্রার্থনা করেন নুরুদ্দিন তাতে সাড়া দিয়ে সেলাউদ্দিন আইয়ুবের চাচা আসাদ উদ্দিন শিরক ও নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেন। 


গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী


সেই সেনাবাহিনীতে শির্কর বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন তার তরুণ ভাতিজা সালাউদ্দিন আইয়ুব্বী এই বাহিনী মিশর থেকে ক্রসেডারদের কে বিতাড়িত করতে সমর্থ হয় অতঃপর শিরককে মিশরের উজির হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় অল্পদিন পর চাচা শিরক মৃত্যুবরণ করলে তার একান্ত সহযোগী ভাতিজার সালাউদ্দিনকে দেয়া হয় উজিরের মিশরের দায়িত্ব এরও কিছু কাল পর ফাতিমা ও খলিফা আল আদিব মারা যান।


নূরুদ্দিন জঙ্গির নির্দেশে সালাউদ্দিন মিশরের ক্ষমতা দখল করেন এবং ফাতিমা ও খেলাফতের বদলে আব্বাসীয় খেলাফতের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন তিনি এক হাতে মিশরে ফাতিমায়দের বিদ্রোহ দমন করেন অন্য হাতে উদ্ধত পরিস্থিতিতে খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেন অসামান্য দক্ষতা ও নেতৃত্ব গুণে মাত্র ৩১ বছর বয়সে মিশনে নিজের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন সালাউদ্দিন আইয়ুবী সালাউদ্দিন যখন মিশরে নিজের একচত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন তখন তার কাছে আসে এক ভয়ানক দুঃসংবাদ সুলতান নূরুদ্দিন জাঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছে।


 নূরুদ্দিন জঙ্গির এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু সালাউদ্দিন হত বিউফল করে দেয় কেননা মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় কোন নেতা ছিল না যার অধীনে মুসলিমরা ঐক্যের পথে সুগম হয়েছিল আর যার তলোয়ার নূরুদ্দিনের মত এতটা ধারালো ছিল নুরুদ্দিনের মৃত্যুর পর সালাউদ্দিন তার সামনে নেতৃত্বের তীব্র শূন্যতা অনুভব করেন আর এই অবস্থায় নিজের আজীবনের লালিত স্বপ্ন আর নুরুদ্দিন জঙ্গির অসমাপ্ত কাজ তাকে প্রতিনিয়ত ধারণা দিতে থাকে অতঃপর নিজের পথ নিজেই রচনা করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুব।


এগারোশো ৭৪ সালে মারা যান নুর উদ্দিন জঙ্গি তার মৃত্যুর ১৩ বছর পর ফিলিস্তিন জয় করেন সালাউদ্দিন এই ১৩ বছরে তিনি মিশরের পাশাপাশি সিরিয়া ম্যাসোফটেনিয়া হেজাজ ইয়ামেন ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকায় নিজের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি গড়ে তোলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ নিয়মিত সেনাবাহিনী এর বাইরেও অসংখ্য অনিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন যারা উম্মার যে কোন প্রয়োজনে নিজেদের জীবন সম্পদ উৎসর্গ করে যুদ্ধের ময়দানে শামিল হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।


সালাউদ্দিন এর সকল সামরিক তৎপরতার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ক্রসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেমকে পুনরুত্থার করার তবে কুষ্ট রোগে আক্রান্ত জেরুজালেমের রাজা চতুর্থ বল্টু ইন যতদিন বেঁচে ছিলেন সালাউদ্দিন জেরুজালেম আক্রমণ করেননি বল্টু ইন জেরুজালেমে মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিয়ে সালাউদ্দিন এর সাথে শান্তি চুক্তি করেছিলেন এবং যতদিন বেঁচে ছিলেন এই চুক্তি প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বোলডুঈন এর শেষ জীবনে ক্রসেডারদের একজন জেনারেল রেনাল্ড অফ শাকিলুল মুসলিমদের একটি কাফেলায় হামলা করে ব্যাপক হত্যাযোগ্য চালায়।


খবর পেয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সুলতান সালাউদ্দিন আইউবী জেরুজালেম অভিমুখে রওনা হন কিন্তু রাজা চতুর্থ বোলটুইন চুক্তি ভঙ্গকারীর অ্যানসার কে বন্দি করেন এবং সালাউদ্দিনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে পুনরায় শান্তির আহ্বান জানান সালাউদ্দিন তার অনুরোধ মেনে নিয়ে ফিরে যান এই ঘটনার অল্পকাল পরেই চতুর্থ বোলটুইন মারা যান তার মৃত্যুর এক বছর পর জেরুজালেমের সিংহাসনে বসেন গাই অবলু সিগনাল ক্ষমতায় বসেই তিনি বিশ্বাসঘাতক রেনালট অপশনটির মুক্ত করে দেন আর রেনালটর তার মুসলিম বিদ্বেষ প্রদর্শন করতে এতটুকু দেরি করেনা পুনরায় সে চুক্তি লঙ্ঘন করে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হামলা করে এবং নির্বিচারে মুসলিমদের উপর হত্যাযোগ্য চালায়।


গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী

এমনকি তারা সালাউদ্দিনের বোনকেও হত্যা করে সুলতান সালাউদ্দিনের কাছে যখন এই সংবাদ পৌঁছে তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে জেরুজালেম অভিমুখে অগ্রসর হন তিনি জানতেন এবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই ক্রসেডার রা চুক্তি লংঘণ করেছে সুতরাং তিনিও যুদ্ধের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যান আঠারোশো ৮৭ সালের ৪ জুলাই জেরুজালেমের নিকটস্থ হৃদপিন্ড নামক স্থানে স্যালাউদ্দিনের মুখোমুখি হয় ক্রসমিনারদের সবচেয়ে বড় বাহিনী ৩০০০০ আইউবি সেনার বিপরীতে ছিল ৫০০০০ ক্রসেডার আর ক্রসেডারদের সম্মিলিত এই বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডোর ছিলেন জেরুজালেমের রাজা গাই অবলু সিগনান।


তবে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগেই ক্রসেটেররা হেরে গিয়েছিল কৌশলী সালাউদ্দিন এর কাছে হৃদপিন্ডে অসংখ্য পানির কোক ছিল যেগুলো ছিল তীব্র গরমে যুদ্ধাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সালাউদ্দিন সেগুলো দখল করে নেন এবং বাকিগুলো ধ্বংস করে দেন হৃদপিন্ডে পৌঁছে পানির অভাবে খ্রিস্টান সেনারা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে আইউবি সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার মতো শক্তি তাদের অবশিষ্ট ছিল না ফলে নিজেদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আইয়ুবি বাহিনী ক্রসেডারদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন।


৫০০০০ খ্রিস্টান যোদ্ধার মধ্যে মাত্র ৩০০০ সেনা পালাতে সক্ষম হয় বাকিদেরকে হত্যা ও বন্দি করা হয় অতঃপর বন্দি রাজা ও কমান্ডোর দেরকে সালাউদ্দিন এর সামনে আনা হয় সালাউদ্দিন তার চিরাচরিত উদার্যের নিদর্শন হিসেবে তৃষ্ণায় কাতর রাজা গাই ও ব্লু সিগন্যালের হাতে বরফ মেশানো পানির পাত্র তুলে দেন বিব্রত গাই ও ব্লু সিগন্যাল তা পান না করে বরং রেনউল্ডের দিকে এগিয়ে দেন রেনউলড নির্লজ্জের মত তা গিলতে শুরু করে অতঃপর সালাউদ্দিন রেনউল্ডকে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত করেন।


রেনউল উদ্যোক্তার সাথে জবাব দেয় রাজারা সবসময় এভাবেই কাজ করে আমি এর বেশি কিছু করিনি সালাউদ্দিন নিজের তরবারি দিয়ে উদ্ধত রেনউলের মস্তক আলাদা করে দেন ফিলিস্তিনের রাজা ও নিজের ব্যাপারে একই পরিণতির কথা কল্পনা করে চোখ বন্ধ করে ফেলেন। সালাউদ্দিন তাকে অভয় দিয়ে বলেন একজন রাজা কখনো অপর রাজা কে হত্যা করে না রেনউল্ড হত্যা করেছে কারণ সে বিশ্বাসঘাতকতার সকল সীমা অতিক্রম করেছে অতঃপর তিনি গাই অবলু সিগন্যালকে বন্দি করেন এবং পরবর্তীতে তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত করে দেন।


হিট্রিনের যুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সালাউদ্দিন ধাপে ধাপে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হন ক্রসেডারদের মূল বাহিনীর পরাজয় মুসলিম ফৌজের সামনে নিকটস্থ সাপ শহর আর দুর্গজয়ের পথ খুলে দিয়েছিল আইয়ুব সেনারা একে একে টাইবেরিয়াস আক্কা এস কেলন নেবলুস ও মামলা ও গাজা দখল করে নেয় মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে ছোট বড় মিলিয়ে বাহান্নটি শহর মুসলিমদের দখলে চলে আসে অতঃপর তারা রওনা হন শত বছর ধরে মুসলিমদের রক্ত আর অশ্রু ভেজা জেরুজালেম জয়ের উদ্দেশ্যে।


এগারোশো ৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আয়ুবি সেনারা জেরুজালেম অবরোধ করেন দুর্গের ভেতর থেকে তখন শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন ইভিলিনের শাসক ব্যালিয়ান তিনি আয়ুবি সেনাবাহিনীকে দুর্গের বাইরে বেশ কয়েকদিন আটকে রাখতে সমর্থ হন সালাউদ্দিন মিঞ্জানিক যন্ত্রে সাহায্যের বড় বড় পাথর ছুঁড়ে দুর্গের প্রাচীর ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন কিন্তু এই প্রাচীর এতটাই মজবুত ছিল যে তা পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থাকে তবে শেষ পর্যন্ত উত্তর দিকের দেয়ালে হামলা চালিয়ে সফলতা পান সালাহউদ্দিন ওই পাশটার দেয়াল কিছুটা দুর্বল ছিল কয়েকটি পাথরের আঘাতেই তা ধসে পড়ে ভ্যালিওনের নেতৃত্বে তার সেনারা সেখানে প্রাননপন প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং অকাতরে জীবন দিতে থাকে তবে ব্যালিউন জানতেন তিনি শেষ রক্ষা করতে পারবেন না।


তিনি সালাউদ্দিন আয়োবীর কাছে শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন তিনি বলেন আমাদের সকল সেনা ও সাধারণ নাগরিককে নিরাপদে শহর ত্যাগ করতে দিতে হবে নইলে আমরা এই শহরের সবকিছু ধ্বংস করে দেবো এমনকি আমাদের হাতে বন্দি ৫০০০ মুসলিমকে হত্যা করব আর যদি আমাদেরকে নিরাপদে বের হতে দেওয়া হয় তাহলে আমরা মুক্তিপণ দেবো এই শহরের কোন ফসল নষ্ট করব না কোন ঘরবাড়ি নষ্ট করব না আর আমাদের হাতে বন্দি মুসলিমদেরকে মুক্ত করে দেবো সালাউদ্দিন বিনা বাক্য বেয়ে তার সকল শর্ত মেনে নেন কেননা তিনি খ্রিস্টানদের উপর বদলা নিতে আসেননি তিনি এসেছেন জুলুমের রাজত্ব থেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে।


তবে তরুণ কমান্ডার ব্যালিয়ান সালাউদ্দিন আয়ুবির ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না তিনি সংশয় প্রকাশ করে বলেন খ্রিস্টান যোদ্ধারা এই দুর্গ জয় করার পর মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল আজ আমরা আত্মসমর্পণের পর আপনিও খ্রিস্টানদের কে নির্বিচারে হত্যা করবেন না তার নিশ্চয়তা কি সালাউদ্দিন বলেন আমি তাদের মতো নই আমি সালাউদ্দিন, সালাউদ্দিন আইউবী অতঃপর খ্রিস্টান সেনারা দুর্গ ত্যাগ করে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে জেরুজালেমের সমাপ্তি ঘটে ক্রসেডারদের টানা ৯ দশকের শাসন দীর্ঘ ২৮ বছর পর সেখানে উচ্চারিত হয় আযানের ধ্বনি সালাউদ্দিন আয়ুবী যতদিন বেঁচে ছিলেন ক্রসেডাররা পুনরায় জেরুজালেম দখল করার বহু চেষ্টা করেছে।


রাজা রিচার্ডের মতো দুর্ধর্ষ কমান্ডার ইংল্যান্ড থেকে ছুটে আসেন আর তার অগণিত সাহসী যোদ্ধাকে নিয়ে জেরুজালেম দখল করার চেষ্টা করেন কিন্তু সালাহ উদ্দিনের দরবারের সামনে তাদের সব চেষ্টা মুখ থুবরে পড়ে এগারোশো ৯৩ সালের ৪ মার্চ সিরিয়ার দামেশকে ইহলোক ত্যাগ করেন ইসলামের ইতিহাসের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র মৃত্যুর সময় তার ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে ছিল মাত্র একটি স্বর্ণমুদ্রা আর চল্লিশটি রোপ্যমুদ্রা অথচ তিনি ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে দাপুটে শাসক সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ তিনি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছিলেন সালাউদ্দিন তার জীবনের ১ মহান লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন তিনি ছিলেন মুসলিম উম্মাহর প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল একজন নেতা অনুকরণীয় শাসক আর দ্বীপ বিজয় সেনাপতি তার জনগণ আর সেনারা তাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো আর তার জন্য অকাতরে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল।


গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী


 তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে একজন মুসলিমকে নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয় আর সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবনভর সংগ্রাম করতে হয় ক্রেসিডেন্টরা যখন জেরুজালেম দখল করেছিলতখন তারা বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে কেবল মুসলিম ৯ ইহুদিদের কেউ উচ্ছেদ করেছিল সালাউদ্দিন বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করার পর সেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিস্টান আর ইহুদীদের কেউ ধর্মীয় আচার পালনের পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন।


 অথচ সেই পবিত্র ভূমিতে এই ইহুদীদের হাতেই মুসলিম নিধন চলছে গত প্রায় একশো বছর ধরে এই একশো বছরের ইতিহাসে মুসলিম বিশ্বে শত কোটি মানুষের জন্ম হয়েছে কোটি কোটি ঘরে মিলাদ হয়েছে ফিলিস্তিন বাসীদের জন্য মোনাজাত হয়েছে অগণিত ওয়াজ মাহফিলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গর্জন উঠেছে। কিন্তু এই ১০০ বছরের ইতিহাসে হতভাগ্য মুসলিমদের ঘরে একজন সালাহ উদ্দিন আয়ুবির ও জন্ম হয়নি এই ১০০ বছরের ইতিহাসে ঐক্যহীন মুসলিম জাতি একটি দিনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। 


Post a Comment

0 Comments