মৃত্যুর সময় আবু জাহেলের শেষ ইচ্ছার অবিশ্বাস্য কাহিনী

 মৃত্যুর সময় আবু জাহেলের শেষ ইচ্ছার অবিশ্বাস্য কাহিনী


আবু জাহেলের শেষ ইচ্ছা


বদরের প্রান্তর প্রাণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ মদিনার মুসলিম প্রতিপক্ষ মক্কার কুরাইশ কাফের বাহিনীএকদিকে রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে তিনশো ১৩ জন মরদেহ মুজাহিদ অন্যদিকে আবু জাহেলের নেতৃত্বে তিনগুণ শক্তিশালী কাফের বাহিনী

একদিকে ছিলেন আমির হামজা আর আলী রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহুর মত আল্লাহর ২ সিংহছিলেন ওমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু আর সাদ বিন আবু ওয়াক্কাসের মতো মৃত্যুভয়হীন একেকজন যোদ্ধা। অন্যদিকে ছিল আবু জাহেল উদবা ইবনে রাবিয়া ওমাইয়া ইবনে খালফের মত অহংকারিক কুরাইশ নেতা আর তাদের অগণিত অনুসারী

প্রতিপক্ষের অধিকাংশই ছিল নিজেদের আত্মীয় স্বজন কিন্তু সত্য ও মিথ্যার প্রশ্নে আজ তারা ২ দলে বিভক্ত একদল আল্লাহ তা নবীর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত অন্যতল ইসলামের আলোকে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দিতে প্রাণপণ প্রতিজ্ঞাপদ্ধ এই ছিল এমন এক যুদ্ধ

যেখানে পিতার মৃত্যুতে অশ্রু মুছে উল্লাস প্রকাশ করেছিল ঐশ্বজাত পুত্র কোন পার্থিব চাওয়া নয় বরং সত্য মিথ্যার প্রশ্নে তারা অস্ত্র ধারণ করেছিল একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ভয়ানক পদাতিক সেনা আর অসাড়ুহিদের সম্মিলিত পদাখাতে উৎক্ষেপ্ত ধূলিতে অন্ধকার হয়ে আসে বদরের প্রান্তর ধেয়ে আসা শত্রু বাহিনীর মোকাবেলায় পেছনে ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগ ছিল না।

ঘনয়মান ধূলিতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে কেবল শত্রু মিত্র চিনে নাও অতঃপর শত্রুকে আঘাত করো আর মিত্রকে রক্ষা করো এভাবেই চলতে থাকে বদরের যুদ্ধ আহত মানুষ আর প্রাণীর চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে ধূসর মরুপ্রান্তর

এই যখন পরিস্থিতি তখন বদরের এক প্রান্তরে মাটিতে লুটিয়ে কাতরাতে দেখা যায় এক কোরায়েশ নেতাকে তার পরনে ছিল অভিযাত পোশাক যন্ত্রণায় তার মুখ বিকৃত হয়ে এসেছিল ডান পায়ে সৃষ্টি হয়েছিল গভীর ক্ষত আর ফিমকি দিয়ে বের হয়ে আসছিল তাজা রক্ত

ব্যথায় যন্ত্রণায় শারের মত ঘোঙাচ্ছিল লোকটি অভিজাত পোশাক পরিহিত ওই কোরাইশ নেতার নাম ছিল আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানীদের পিতা কোরাইশরা তাকে এই নামে ডাকতো কেননা তাদের দৃষ্টিতে সে ছিল মক্কার সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কিন্তু আল্লাহর নবী তার নাম দিয়েছিলেন আবু জাহেল

অর্থাৎ মূর্খদের পিতা সে ছিল অহংকারী আর সত্যবাদী মানুষদের প্রতি অত্যাচারী নিজের সমস্ত অহংকার নিয়ে আছে মাটিতে পতিত তার এই দুর্দশা করেছে মদিনার দুই কিশুর যারা সম্পর্কে ছিল সহধর আর বয়সী ছিল বালক মাত্র

আবু জাহেলের শেষ ইচ্ছা


আবু জাহেলকে আঘাত করতে গিয়ে বালকদের একজন নিহত হয় আরেকজন গুরুতর আহত হয় তবে তার আগেই তারা আবু জাহেলকে যখম করতে সমর্থ হয় কিন্তু এই যখম তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিলো না নিজের রক্তাক্ত পা দুটি টেনে কোনরকম নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আবু জাহেল খানিকটা দূরে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল আবু জাহেলের পুত্র ইকরাম

গুরুতর আহত অবস্থায় নিজের পিতাকে মাটিতে পড়ে কাতরাতে দেখে সে ছুটে আসার চেষ্টা করে নিজের জন্মদাতা পিতাকে রক্ষা করতে কিন্তু বিধি বাম তার পথ আগলে দাঁড়ায় মুসলিম সেনারা পিতাকে রক্ষার বদলে নিজের প্রাণ রক্ষায় মনোযোগ দিতে বাধ্য হয় আবু জাহেল পুত্র ইকরাম এদিকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা আবু জাহেলের দিকে হাটিহাটি পায়ে এগিয়ে যান একজন সাহাবী

তার হাতে ছিল খোলা তলওয়ার তার চোখে ছিল আগুনের মত, তিনি ছিলেন মক্কা থেকে বিতাড়িত এক নির্যাতিত মহাজীর নাম আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু মক্কায় বসবাস কালে তাকে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করত এই ঘৃণিত আবু জাহেল আর তাকে সম্বোধন করত নিচু জাতের রাখাল হিসেবে আবু জাহেলের নিকটে পৌঁছে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন

ওহে আল্লাহর শত্রু চেয়ে দেখো তোমার কি নির্মম পরিণতি করেছেন আল্লাহতায়ালাআবু জাহেল বললো তুমি তো এক রাখাল ছিলে মোহাম্মদের দলে যোগ দিয়ে বেশ ভালোই তো উন্নতি করেছো তিনি বললেন হ্যাঁ আমি সেই রাখাল যাকে ইসলাম গ্রহণের কারণে মক্কায় তুমি প্রকাশ্যে মারধর করতে আর রাস্তার পাশে ফেলে রাখতে

তুমি সেদিন আমাকে যেভাবে লাঞ্ছিত করতে আজ আল্লাহ তোমাকে তার চেয়ে বেশি লাঞ্ছিত করেছেন অতঃপর ঘৃণিত আবু জাহেলের বুকের উপর পা চেপে ধরেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু আর তাকে স্মরণ করিয়ে দেন ইসলামের বিরুদ্ধে তার প্রতিটি অন্যায়ের কথা

সেই আবু জাহেল যে আল্লাহর সত্য দিনের বিরুদ্ধে প্রতিটি ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দিয়েছে রসূলের সাথীদের ওপর নির্মম নির্যাতনে মক্কার কুরাইশ নেতাদেরকে উস্কানি দিয়েছে প্রয়োজনে বাধ্য করেছে সেই আবু জাহেল যে দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন সাহাবীদের সাথে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট আচরণ করেছে এই সেই আবু জাহেল যে নিরপরাধ সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে লজ্জাস্থানে বর্ষা দিয়ে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল

যার জুলুমের ধকল সহ্য করতে না পেরে শহীদ হয়েছিলেন সুমাইয়া স্বামী ইয়াসির রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু যার নেতৃত্বে হিজরতকালে স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম কে হত্যা করার জন্য কুরাইশদের খাদক দল করে উঠেছিল এই সেই আবু জাহেল যার উস্কানিতে আজকে বদরের ময়দানে কোরায়েশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে যুদ্ধের প্রাককালে যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিল অধিকাংশ কোরায়েশ নেতা

কিন্তু আবু জাহেল বলেছিল তোমরা কাপুরুষ তোমরা ভীরু তোমাদের উচিত নিজেদেরকে পুরুষ পরিচয় না দিয়ে বরং রান্নাঘরে আশ্রয় নেয়া তার এই প্ররোচনাতেই কোরায়েশ নেতারা যুদ্ধে নেমেছে সেই পাপিষ্ঠ আবু জাহেল এখন লাঞ্ছনাদায়ক মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে, মাসুদ রাঃ তাকে বললেন হে আল্লাহর শত্রু আমি তোমার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দেব আর এটাই হবে তোমার উপযুক্ত শাস্তি

আবু জাহেলের শেষ ইচ্ছা


জবাবে আবু জাহেল বলল এটা তোমার জন্য সৌভাগ্য যে তুমি একজন সম্মানিত কোরায়াশ নেতাকে হত্যা করতে যাচ্ছো এর আগে কখনোই তুমি আমার মতো সম্মানিত কাউকে

শত্রু হিসেবে পাওনি আফসুস তোমার মত রাখালের হাতে মৃত্যু না হয়ে যদি কোন সম্ভ্রান্ত শত্রুর হাতে আজ আমার মৃত্যু হতো? মৃত্যুর আগে একটি অনুরোধ তুমি আমার গলা গোড়া থেকে কাটবে যেন তোমার নবীর সামনে আমার কাটা মস্তক রাখলে তা মাটিতে মিশে না থাকে বরং মাটি থেকে উঁচু হয়ে থাকে আবু জাহেল সম্পর্কে আল্লাহর নবী বলেছিলেন সে হচ্ছে এই উম্মতের ফেরাউন ফেরাউন যখন লোহিত সাগরে ডুবে মরছিল তখন সে নিজের সারা জীবনের অহংকার জলাঞ্জলি দিয়ে আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো জীবন ভরকৃত অন্যায়ের জন্য সে অনুশোচনা করেছিল

কিন্তু আজ আবু জাহেল ছাড়িয়ে গেলো সেই ফেরাউনকে এমন ঘৃণিত মৃত্যু সত্ত্বেও সে নিজের অহংকার থেকে বের হতে পারেনি নিজের শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করে সে বলে আমার মস্তক যখন তোমার নবীর সামনে রাখা হবে তা যেন মাটি থেকে উঁচুতে থাকে এতে তোমার নবী জানবেন তিনি একজন সম্ভ্রান্ত কুরাইশকে হত্যা করেছেন অতঃপর পূরণ করা হয় আবু জাহেলের অন্তিম ইচ্ছা তাকে ঠিক সেইভাবে হত্যা করা হয় যেভাবে সে চেয়েছিল আর নিজের সমস্ত অহংকার সমেত তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় জাহান্নামে যার ব্যাপারে তাকে বারবার সতর্ক করা হয়েছিল আবু জাহেল ছিল একজন বিজ্ঞ ও নেতৃত্বের যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি

নিজের অগণিত গুণের কারণে কোরায়াশদের মধ্যে সে খুব অল্প বয়সেই নেতৃত্বের জায়গায় উঠে এসেছিল মক্কায় তার প্রভাব প্রতিপত্তি এতটাই বেশি ছিল যে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করেছিলেন হে আল্লাহ তুমি আবু জাহেলকে কিংবা ওমরকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করে দাও আল্লাহতালা ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কে কবুল করেছিলেন কিন্তু আবু জাহেলকে করেছিলেন লাঞ্ছিত

কেননা সেই ছিলো অহংকারী আর পাপাচারী জ্ঞানের অহংকার আর নেতৃত্বের লোভ তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল যারা আল্লাহর জমিনে দম্ভ সহকারে বিচরণ করে বেড়ায় সত্যের মোকাবেলায় যারা মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে আর নিজেদের জ্ঞানের অহংকারকে পুঁজি করে সত্যের বিরোধিতা করে

নিশ্চয়ই আল্লাহতালা তাদের জন্য রেখেছেন মর্মন্তুত পরিণতি। 


Post a Comment

0 Comments